মেঠোপথের বুকচিরে মানুষের পদচিন্হ । দুইধারে কিছু ফ্যাঁকাসে, যেন পাথরের নিচে চাপা পড়া দুর্বা ঘাসের আধোমরা লতাগুলো উকি মেরে মাথাটা উপড়ে তুলতে চাইলেও রুক্ষ কঙ্কালসার এই প্রকৃতির মাঝে সে নিজেকে মেলে ধরতে পারছে না । তাই আপাত দৃষ্টিতে তার বুক এখন খাঁ খাঁ করছে । যদিও মেঠোপথের মাঝখানটায় হালকা ধুসর বালুকণার কল্যাণে মরুভুমির মরিচিকার স্বাদ অনুভব করছে বেশি, হয়তোবা এটা স্বান্তনা খোঁজার শেষ প্রয়াস হিসেবে দুর্বা ঘাসগুলোর প্রানান্ত উকি মারা চাহনির ফল । সময়টা ১৯৭১ সাল । অক্টোবর মাস প্রায় গড়িয়ে গেছে একবুক হতাশায় । গ্রাম ছেড়ে মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে ছাত্তার পৌছালো তেমাথার মোড়ে সদা দাড়িয়ে থাকা আমগাছটার তলে, দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে একদৃষ্টিতে আকাশের পানে চেয়ে আছে । মধ্য আকাশে সূর্যটা যেন টগবগ করে জ্বলছে, গাছের ছায়া ভেদ করেও যেন তা ছাত্তারের গায়ে লাগছে । মৃদু বাতাস বইলেও তা যেন ছাত্তারের গায়ে স্পর্শ করছে না, তার সারা শরীর ঘামছে । তার সামনের খোলা প্রান্তর এখন খাঁ খাঁ করছে, চারিদিকে সব সবুজ যেন আজ আগুন লেগেছ, কোথাও কোন ফসলের চিন্হ নাই । রিক্ত বাতাসের সাথে এখন পুরোগ্রাম অভাবে হাহাকার করছে । মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুমুঠো অন্ন যোগার করবে সে ব্যবস্হা এই দুঃসময়ে গ্রামের হাড়ভাঙ্গা খেটে খাওয়া মানুষগুলো করতে পারে না । তাই বেশির ভাগ সময় এদের অনাহারে অর্ধাহারে কাটে । গ্রামের যে দুচারজনের গোলায় ধান আছে তাদের উঠানে এই অভাবী মুখগুলোর পা ফেলার সাধ্য নাই, কারন তারা এখন ধানের বদলে জমি কেনে । অভাবী মুখগুলোর মাঝে ছাত্তার ও একজন । আজ তার বাড়ির উনুনে আগুন জ্বলে নি । তাই পেটেও কিছু পড়েনি । বাড়িতে উপার্জনক্ষম একমাত্র সেই , যেহেতু দেশে কোন কাজ কর্ম নাই তাই দুবেলা দুমুঠো খাবারেও ভাটা পড়েছে । বৃদ্ধ বাবা মা আর তার এক ছোট বোন মিলে ছোট্র একটা সংসার তবুও তাদের মুখে কোন খাবার তুলে দিতে পারেনা ছাত্তার । চারিদিকে হাহাকারের ক্রন্দনরোলের মাঝে সে খেই হারিয়ে ফেলে, অনাহারী তিন মুখ সদা সর্বদা তার পানে চেয়ে আছে, এই ভেবে তার বুক টা কেপে ওঠে কিন্তু তার সামনে কোন পথ খুজে পায়না যেখান থেকে সে তাদের জন্য একটু হাসি এনে দিতে পারে । এদিকে তাদের গ্রামের পাশের শহরের ষ্টেশনে পাকিস্থানি বাহিনী এসে ঘাটি গেড়েছে । তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যয় এদেশের কিছু রাজাকার,আলবদর, আলসামস রা তাদের সাথে হাত মিলে নিরীহ মানুষ জনের মালামাল লুট করছে,হত্যা নির্যাতন চালাচ্ছে । ছাত্তারের মনে এগুলো তেমন রেখাপাত করে না কারন তার পেটে এখন ক্ষিদে । মলিন বিমর্ষ মুখে শুধু অপলক দৃষ্টিতে আকাশের পানে চেয়ে ক্ষনে ক্ষনে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । ফলে বাতাসে কলঙ্কের ছাপ পড়ে, যেখানে এ বাংলার মানুষ শুধু এ বাতাস কে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে এক চিলতে হাসি না পাওয়ার বেদনায় । ছাত্তারের বৃদ্ধ মা কোথা হতে দু মুঠো আটা যোগার করে জাউ রান্না করে তার পানে চেয়ে আছে, কিন্তু সকাল হতে দ্বিপ্রহর অবধি তার কোন দেখা নাই । তার বৃদ্ধ বাবা মলিন মুখে বলে হয়তোবা কাজের খোজেঁ গেছে তাই ছাত্তারের আজ আসতে দেরি হচ্ছে । ছাত্তারের মা তার পানে চেয়ে থাকা ছাড়া আর বলার মত কোন ভাষা খুজে পায় না । তার বাবা বলে ছেলেটা কোন কাজ না পেলে তো না খেয়েই আমাদের মরতে হবে , এভাবে জাউ আর পানি খেয়ে কতদিন বেচে থাকা যায় । ছাত্তারের মা করুন কষ্টের লোনাপানি বুকে ধারন করে তার দোচালা আধোভাঙ্গা ঘুনে খাওয়া রুমে গিয়ে মুখ লুকায় । বেঁচে থাকার অমোঘ বেদনা তাকে সর্বদা কুড়ে কুড়ে খায় । আর তার ছোট বোন টা সদা সর্বদা তার বাবা মার করুন মুখটার পানে অপলক চেয়ে থাকে । ছাত্তার গাছতলা থেকে উঠে পড়ে, তার মাথা এখন ঝিন ঝিন করছে যেন মাতাল হয়ে গেছে, শরীর ঢুলতে থাকে, মনে হয় এই মুহুর্তে সে নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না । পিছন দিক থেকে লোকমান এসে তার কঁাধে হাত দেয় , ছাত্তার ঘাড় ফিরে পিছনে তাকায় দেখে লোকমানের চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ । ছাত্তার মুহুর্তেই তার সকল শারিরীক দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে বলে কি লোকমান চাচা তোমার কি হইছে? তোমার কি কেউ মরছে টরছে নাকি? তোমাকে দেখে তো মনে হয় আজরাইল তোমার পিছনেও লাগছিলো । লোকমানের চেঁাখের কোনে সামান্য লোনা পানি টলমল করে, হয়তো ঝড়ে পড়ার মত পর্যাপ্ত পানি তার চেঁাখের কোঠরে নাই তাই সহসাই চিবুকে ঠাই মিলছে না কিন্তু কষ্টের এ লোনা পানির উপস্হিতি টের পেতে ছাত্তারের কোন কালক্ষেপন হয় না । বয়সে লোকমান ছাত্তারের চেয়ে অনেক বড় । প্রায় ষাটার্ধ তার বয়স । শরীরের মাংশাপেশি তার মলিন নিস্তেজ হয়ে গেছে । সে ছাত্তারের মুখের দিকে করুন পানে চেয়ে বলে, রেলষ্টেশনের পাশের গ্রামে আমার যে বড় ভাই থাকে তার বাড়িতে পাকবাহিনীর সহয়তায় রাজাকার আলবদর রা হামলা চালিয়ে সব লুটপাট করে নিছে তার গায়ে তারা হাত তুলতেও একটু দ্বিধা করে নাই তার অপরাধ একটাই সে নাকি এই দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলছে । এই মুহুর্তে তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মত কেউ নাই করুনা করা তো দুরের কথা । রাজাকাররা নাকি বলছে যে ওকে সাহায্য করতে আসবে তারও পরিনতি নাকি একই রকম হবে । এই ভয়ে তার আশেপাশেও কেউ আসছে না । লোকমান ছাত্তারের একহাত টেনে ধরে তার বুকের সাথে লেপ্টে ধরে বলে বাবা তুই আমার ছেলের মত, তোর গায়ে শক্তি আছে, সামর্থ আছে তুই ই পারিস এই দেশের জন্য কিছু করতে, তুই ই পারিস দেশকে এই হানাদার দের হাত থেকে মুক্ত করতে, তোদের রক্ত এখন গরম তোরাই এখন করতে পারিস যেকোন অসাধ্য সাধন । আমার যদি আজ কোন ছেলে থাকতো তবে তাকে আমি আজ যুদ্ধে পাঠাতাম । আমি জানি তোর ঘরে তোর বৃদ্ধ বাবা মা আছে যারা সদা সর্বদা তোর মুখের পানে চেয়ে আছে, তুই এ নিয়ে কোন চিন্তা করিস না আমি বেচে থাকতে আমার মুখে যদি একমুঠো ভাত পড়ে তো তোর বাবা মার মুখেও একমুঠো ভাত পড়বে এ প্রতিশ্রুতি আমি আজ তোকে দিলাম । তুই যুদ্ধে যা, দেশের জন্য যুদ্ধ কর । দেশের জন্য অস্ত্র ধরে দেশকে মুক্ত কর । সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ নে । শুনছি আমাদের ঐ পাশের থানা তাড়াশে মুক্তিবাহিনী আসছে, তোর মত সুঠাম দেহের তরুন পোলাপান দলে দলে যোগ দিচ্ছে দেশকে মুক্ত করার জন্য । আমি চাই তুই ওদের সাথে যোগ দে, দেশের জন্য লড়াই কর । ছাত্তার কোন কথা বলে না সে শুধু লোকমানের মুখের পানে চেয়ে থেকে, নিরব দৃষ্টিতে এসব কথা শুনছে । লোকমান ছাত্তারের কাছ থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বিমর্ষ নয়ন আর মুখায়ব অবলম্বন করে তার নিজের বাড়ির দিকে রওনা দেয় । ছাত্তার আর একমুহুর্ত এখানে দেরি করে না । সেও তার বাড়ির পথে রওন দেয় । বাড়ি পৌছে তার প্রতীক্ষায় দন্ডায়মান বাবা মাকে দেখতে পায় । বাবা মার চোখের পানে চেয়ে বলে তোমরা আমার জন্য দোয়া কর আমি আজ যুদ্ধে যাব । আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত স্বাধীন করবো । আমার দেশের সব সবুজ ফিরিয়ে আনবো যা রেখে যাব পরবর্তী প্রজন্মের জন্য | বাবা মার অপোলক দৃষ্টির পানে সে চেয়ে বলে তোমরা কোন চিন্তা করনা তোমার ছেলে এ দেশকে মুক্ত করবে আর মুক্ত দেশ তোমাদের পায়ে ছালাম করবে আর তোমাদের দেখবে । মা-র অভাবী দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড় গড় করে ঝড়ে পড়ে । ছাত্তার বলে মা তুমি ভেবোনা তোমার ছেলের জন্য দোয়া কর সে দেশকে স্বাধীন করেই ঘরে ফিরবে । তার বাবা এই মুহুর্তে ছেলের এসব কথাতে বাকরুদ্ধ, একদৃষ্টিতে শুধু ছেলের কথাই শুনছে হয়তো তার আরেক দৃষ্টি দিয়ে সে এই বাংলার করুন অবস্হা অবলোকন করছে । ভাবছে আমার ছেলে যদি দেশের জন্য যুদ্ধ করে আমি হব এ দেশের এক গর্বিত পিতা । ছাত্তারের মা করুন দৃষ্টিতে বলে আমাদের কি হবে বাবা আমাদের কে দেখবে । ছাত্তার পা ছুয়ে বলে ও ভেবো না মা তুমি, শুধু তোমার ছেলের জন্য দোয়া কর । তোমার ছেলে দেশকে মুক্ত করবে আর আমার মুক্ত দেশ তোমাদের দেখবে । সেই দিনই ছাত্তার মুক্তিবাহিনী তে যোগ দিতে তাড়াশের পথে রওনা দেয় মাথায় ও বুকে বাবা মার দোয়া গেথে নিয়ে ।
(আমি স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের একজন, স্বাধীনতা নিজ চোখে না দেখলেও অনুভব করি এখনও বেচে থাকা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার মাঝে ।তেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শোনা বাস্তব ঘটনা নিয়েই আমার এ ছোট গল্প )
১৯ মে - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪